প্রাচীনকালে আর্থ উপনিবেশের বহু পূর্বে বাংলা তথা এ ভারতের কৃষি যার ঐতিহ্য ও সভ্যতার যে শুধুমাত্র সূচনা হয়েছিল তা নয়, তার ছিল যথেষ্ট গৌরবাঞ্ছিত।
পন্ডিত দের মতে বিশ্বের সর্বত্র ঝুম চাষই আনুষ্ঠানিক কৃষির প্রারম্ভ। পূর্ব এশিয়ার লোক সাহিত্য থেকে জানা যায়, তৎকালীন মানুষজন তা মানুষজন তার তাদের স্বজনদের কবর থেকে নানা প্রকারে ফসল চারা গজানোর উঠতে দেখে বিস্মিত হতে শুরু করে। পরে তারা তাদের স্বজনদের কবর থেকে নানা প্রকারে চারা গজানোর উঠতে দেখে বিস্মিত হতে শুরু করে। পরে তারা কবর এর উপরের ঝুরঝুরে মাটি কেই এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরূপ আকস্মিক কিছু ঘটনা থেকেই মানুষের প্রথম ভূমি কর্ষনের চিন্তা মাথায় আসে।
পরবর্তীকালে কালের নিয়মে মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার প্রচলন শুরু করে এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয় ‘ছন্দবদ্ধা মালা’ ‘ছড়া’ বা ‘বচন’, এই ছড়া বা গাথার উল্লেখ বেদ সংহিতা, পুরান বা বৃহৎ সংহিতা র মত নানাবিধ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া গেলেও তার পাশাপাশি তৎকালীন এক বিদুষী খ্যাতনামা জ্যোর্তিবিদ খনা কর্তৃক প্রদও বচনগুলির অবদান আজও বাংলার কৃষিক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। খনার বচনের কিছু সংকলন উদ্ধার করা গেলেও তা পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার বচনে মূলত আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ফসলের চাষ ও জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকর্যের কথা বলেছেন।
খনা একজন অত্যন্ত জ্ঞানী, খ্যাতনামা প্রবচক ছিলেন তা স্পট, তার বলে যাওয়া বিভিন্ন বচনগুলির মাধ্যমে বর্তমানের কৃষি আবহাওয়ার বিজ্ঞান যে সংক্রান্ত ধারনা দেন বহু বছর পূর্বে খনা তার বচনের মাধ্যমে তা দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন চৈত্র থর থর, বৈশাখে ঝড়-পাথর । জৈষ্ঠ তারা ফুটে/তবে জানবে বর্ষা বটে। কোনো বছর চৈত্র মাসে ঠান্ডা থাকলে বৈশাখে ঝড় বৃষ্টি হলে জৈষ্ঠ মাসে আকাশ পরিষ্কার অর্থাৎ মেষশূন্য থাকলে সে বছর বর্ষা ভালো হয়।
শুধু তাই নয় আবহাওয়া ও কৃষির মধ্যে সম্পর্ক যে নিবিড় তাও যিনি জানতেন। তেমনই এক ছড়ার উল্লেখ পাই যেমন দিনে জল, রাতে তারা। সে বছর মুখর ধারা অর্থাৎ যে বছর বর্ষাকালে দিনে বৃষ্টি হয় ও রাতে মেঘ পরিষ্কার হয়ে তারা ফোটে সে বছর শুখ হয় । তিনি আরো বলেছেন “জৈষ্ঠ্য শুখো আষাঢ় এ ধারা শসের ভার না সয় ধারা” অর্থাৎ যে তিনি বলতে চেয়েছেন জৈষ্ঠ্য মাস শুকনো অর্থাৎ বৃষ্টিহিন থাকলে এবং আষাঢ় মাসে ভালো বৃষ্টি হলে সে বছর ফলন খুব ভালো হয়।
কৃষিতে জলসেচের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য তা আজ থেকে শত বছর আগে খনার তার সমন্ধে বলে গেছেন। ” খরা ধুয়ে ঢাকবি জল/ সকল মাসেই পাবি ফল” অথ্যাৎ সেচ দিয়ে চাষ করলে বারো মাস ফলন পাওয়া যায়।
আম, কাঠাঁল, পান, শসা ,সুপারি, পটল, বেগুল, বন্ধু, লাউ ইত্যাদি নানা প্রকার উত্থানজতি ফসল থেকে শুরু করে ধান যব ও বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনের পদ্ধতির খোঁজ মেলে খনার বচনে। কখন রুইতে হবে সে বিষয়ে তিনি বলেছেন কলা “সাত হাতে টিন বিষাদে। কলা লাগাবে মায়ে পুতে / কনা লাগিয়ে না কাটবে পাত/ তাতেই কাপর তাতেই”ভাত”। যার অর্থ হল সাত হাত ওন্তর তিন বিঘত, গর্ত করে কলা লাগাতে হবে এবং কলা পাতা না কেটে ফল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। কলা লাগানোর সঠিক সময় আষাঢ়-শ্রাবন অথ্যাৎ বর্ষাকাল। ভাদ্রে মাসে কলা রোপন করালে বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমন গাছের ঋতি করে তাও তিনি বলে গেছেন।
আজকের দিনে সভ্যতার ক্রমবিবর্তন ও নগরায়ণের চাপে কৃষিবিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বস্তু লারাই খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যার জন্য দরকার প্রতি একর জমির সঠিক ব্যবহার বা বহুস্তরিও কৃষি (Multi cropping System) এর ধারাই সম্ভব। এই প্রসঙ্গে খনা বলে গেছেন -“আগে রুয়ে কলা/ বাগ-বাগিচা ফলা/ শোনরে বলি চাষের কো। পরে নারিকেল আগে গুয়ো/ নারিকেল বারে সুপারি আর্ট। এর যন তখনি কাট”। এর মাধ্যমে তিনি
বোঝাতে চেয়েছেন কোনো জমি বহুস্তরীয় কৃষি ব্যবস্থার শুরু করতে হবে প্রথমে কলা দিয়ে শুরু করতে হবে ও ক্রমান্বয়ে অন্য বাগিচা ফসিলগুলি লাগাতে হবে। ওই জমিতে কলার মাঝে মাঝে আট হাত অন্তর নারিকেল ও আট হাত অন্তর সুপারি গাছ বসাতে হবে।
খনা বলে গেছেন “গো নারিকেল নেড়ে রো আম টুকরো কাঁঠাল ভো”। অর্থাৎ সুপারি ও নারিকেল চারা পুঁতলে গাছ সহজে সতেজ থাকে o কলাবতী হয়, অপর দিকে আম ও কাঁঠাল চারা নেরে পুতলে সেই গাছে ফলন ভালো হয় না বা হলেও ছোট হয়।
নারিকেল গাছের ফলন বৃদ্ধির টোটকা থেকে শুরু করে নিস্ফল নারিকেল গাছকে ফলাবতী করে তোলার উপায়ও বলেছেন খনা। যেমন- “নারিকেল গাছে দিলে লুনেমাটি। শীঘ্র শীঘ্র বাঁধে গুটি। খনারবচন ফিরৎ পাই। মাঝে মধ্যে দিও ছাই”- নারিকেল গাছের গোড়ায় লবন ও মাঝেসাঝে ছাই প্রয়োগ করলে ফলন বৃদ্ধি পায়।গুয়া গোবর বাঁশে মাটি। অফলা নারিকেল শিকারে কাটি অথাৎ কোনও নারিকেল অফলা হলে সেই গাছের কিছু পরিমান শিকড় কেটে দেওয়া উচিত। এতে গাছটি ফলবতী হয়।
আবার মূলা চাষের জন্য আদর্শ সময় ও মাটি কেমন যারা উচিৎ সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন “খনা বলে শুন শুন। শরতের মেষে মূলা বুন। মূলার ভুঁই তুলা। কুশরের ভুঁই ধুলা”। যার অর্থ মূলা বোনার উপযুক্ত সময় শরৎকালের শেষ মূলা চাষের জমি হালকা তুলার মতো হওয়া উচিৎ।
আবার বেগুন চাষের জন্য খনা বলেছেন-” বলে গেছে বরাহের পো। দশটি মাস বেগুন রো। চৈত্র-বৈশাখ দিবে বাদ। এতে নাই কোনো বিবাদ / পোকা ধরলে দিবে ছাই/এর চেয়ে ভালো উপায় নাই। মাটি শুকাইলে দিবে জল / সকল মাস পাবে ফল’। যার অর্থ চৈত্র বৈশাখ বাদে বছরের বাকি যে কোনো সকল সময় বেগুন চারা লাগানো যেতে পারে, এবং এতে পোকার আক্রমন হলে ছাই প্রয়োগ করা উচিত। সারা বছর ফলন পেতে তিনি নিয়মিত ব্যবধানে জলসেচের নিদান দিয়েছেন।
পটলচাষ প্রসঙ্গে তিনি বলে গেছেন- “শুনতে বাপু চাষীর বেটা। মাটির মধ্যে বেলে যেটা। তাতে যদি বুনিস পটল তাতে তোর আসবে সফল”।
লাউ চাষ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন-“উঠান ভরা লাউ শসা তার হবে লক্ষ্মীর দশা”। তিনি আরোও বলেছেন “চাল ভরা কুমড়ো পাতা লক্ষ্মী বলেন আমি তহা”। আবার আরও-এক বলেন-” লাউ ফলের মাছের জলে/ ধেনো মাটিতে ঝাল ফলে। অর্থাৎ মাছ ধোওয়া জলের প্রয়োগে লাউ ও ধানের জমিতে লঙ্কা লাগালে লঙ্কা ফলন বারে।
কিছু মশলা ও আবাদি ফসল যেমন হলুদি, আদা, ও পানের চাষ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনাও খনা দিয়ে গেছেন তার পন্তি গুলিতে। যেমন-” শুনবে ব্যাটা চাষের পো। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠতে হলুদ রো। আষাঢ়ে শ্রাবণ নিরিয়ে মাটি। ভাদোরে নিড়িয়ে করবে খাঁটি। হলুদ রোদে অপর কালে সব চেষ্টা যায় বিফালে। এখান থেকে পাঁট যে বৈশাখ জৈষ্ঠ্য হলুদ রোপন করে আষাঢ়, শ্রাবন ও ভাদ্র মাস জুড়ে মাটি ভালো করে নিদান দিলেই তবেই ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
অপর দিকে পানপাতা লাগানোর সঠিক সময় যে শ্রাবণ মাস তাও নথিভুক্ত হয়েছে খানা র বচনে।
কোন ফসলে কি ধরনের সার প্রয়োগ করা উচিত এ সংক্রান্ত ধারণাও তিনি তার বচনের মাধ্যমে লোকমুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবেই বিভিন্ন প্যাক্তি ও ছন্দে গাঁথা হয়ে আছে বাংলার কৃষি ও খনার বচন। ঠিক যেন একে আপরের পরিপূরক হয়ে বাংলার কৃষি, কৃষি পদ্ধতি ও সর্বোপরি আবহাওয়ার গতিবিধির সাথেও চাষবাসের এরপ যোগসূত্রের স্থাপনের প্রক্রিয়া আজ থেকে বহু বছর আগে বিদুষী খনা শুরু করে গিয়েছিলেন তা থেকেই অবাক হতে হয়। তাই বাংংলার কৃষি সমন্বিত যে কোনও তথ্য আলোচনাতে খরার নাম বারে বারে ফিরে আসে।